নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটক (Dramatist Rabindranath’s Play ‘The Post Office’)

কবি হিসাবে রবীন্দ্রনাথ একজন মহান কবি বটে কিন্তু নাট্যকার হিসাবে তিনি নিতান্তই মাঝারি মানের এবং দ্বিতীয় শ্রেণির।”

কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এমনই এক অশিষ্ট মন্তব্য করেন বিশিষ্ট মারাঠী নাট্যকার গিরীশ কারনাড়।

নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রনাথের নাটক সম্পর্কে এহেন অগৌরবীয় মন্তব্য নতুন কিছু নয়। তাঁর জীবদ্দশাতেই বহু বিরুদ্ধ মতামত শুনতে হয়েছে তাঁকে। অভিমানী কবি কখনও ক্ষুব্ধ,কখনও ব্যথিত হয়েছেন। স্বরচিত, একই নাটকের একাধিক সম্পাদনা করেছেন। বহু নাটকের ভূমিকায় সেই বিশেষ রচনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ব্যাখ্যা করেছেন তার কার্য-কারণ সম্পর্ক। তা সত্ত্বেও সেকালের সাধারণ রঙ্গালয় থেকে একালের অবাধ গবেষণা-মূলক নাট্যচর্চার দীর্ঘ পরিসরে, তাঁর বিচিত্র নাট্যসম্ভার সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হোলো না। যেহেতু তার কারণ হিসাবে, নানা মুণির নানা মতের কথা বহুলচর্চিত,তাই সে কথার পুনরুক্তি না করে, এ প্রসঙ্গে একটা অন্য গল্প বলি।

১৯৪২ সাল।পোল্যান্ড তখন হিটলারের নাৎসী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। দেশ জুড়ে চলেছে ইহুদি নিধন যজ্ঞ। রাজধানী ওয়ারশ শহরের নিজস্ব ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। শহর থেকে দূরে,একটা উঁচু পাঁচিল ঘেরা জেলখানায়, যার নাম ঘেটো।সেখানকার চরম অব্যবস্থার দুর্বিপাকে, অনাহারে কিংবা রোগেভোগে যারা মরবে তারা মরবে। আর যারা বাঁচবে,তাদের মারবার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে নিকটবর্তী গ্যাস চেম্বারে। আবালবৃদ্ধবনিতা, শিক্ষিত,অশিক্ষিত,সব ইহুদিদের জন্য একই রকমের ব্যবস্থা। একটাই নিয়ম।

ওয়ারশ শহরে তাঁর নিজস্ব অনাথ আশ্রম থেকে তখন সদ্য বিতাড়িত হয়েছেন ডাক্তার ইয়ানুশ কোরচাক। আশ্রমিক প্রায় দু’শো জন শিশু আর তাদের বারোজন তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে তাঁকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঘেটোয়, যেখানে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান আরও অনেক ইহুদি। কোরচাক জানেন, এখানে মাত্র ক’দিনের প্রতিক্ষা। তারপর হঠাৎ একদিন–তাদের নিয়ে যাওয়া হবে ত্রেবালিনকা’র মৃত্যুকূপে। সদা হাস্যময় চৌষট্টি বছরের বৃদ্ধের মুখে সেদিন গভীর উদ্বিগ্নতা। ভাবছেন, কী করবেন তিনি? কীভাবে এই সরলমতি শিশুদের তিনি বোঝাবেন, মৃত্যুই জীবনের চরম পরিণতি !

ডাক্তার ইয়ানুশ কোরচাক(পিতৃদত্ত নাম হাইরিক গোল্ডস্মিথ)শুধুমাত্র একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা বিশিষ্ট সাহিত্যিক হিসাবেই নন,পৃথিবীবাসীর কাছে তিনি পরিচিত একজন মরমী শিশুপ্রেমী হিসাবে। কোন অবস্থাতেই একটি শিশু যেন নিজেকে অসহায় মনে না করে সেই লক্ষ্যেই উৎসর্গীকৃত ছিল তাঁর জীবন। তাঁর নিজস্ব শিক্ষা-ব্যবস্থায় পড়াশোনার পাশাপাশি আবৃত্তি, গান ও অভিনয়ের সঙ্গে শরীর -চর্চাও ছিল আবশ্যিক। শৈশবকালেই একটি শিশুকে সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। ওয়ারশ’এর ঘেটো’য় সেই মহান চিন্তাবিদ সেদিন দিশাহারা। অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে কোনভাবেই যে তার প্রাণপ্রিয় শিশুদের রক্ষা করা সম্ভব নয় তা তিনি জানেন। কিন্তু কিভাবে তাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা যায়,সে রহস্যের সন্ধান তার অজানা। চিন্তাক্লিষ্ট কোরচাক, তলিয়ে যান ভাবনার গভীর অন্ধকারে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মনে পড়ে একটি নাটকের স্মৃতি। পড়েছেন বছর কুড়ি আগে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, একজন ভারতীয় নাট্যকার, তাঁরই রচনা। বাংলা ভাষায় নাটকের নাম,ডাকঘর। ইংরেজি অনুবাদে, The Post Office. পোলিশ ভাষায়, পোচতা। কোরচাক সিদ্ধান্ত নিলেন, আশ্রমিক শিশুদের নিয়ে সেই নাটকটিই মঞ্চায়ন করবেন তিনি।

১৯১৯ সালে, পোলিশ ভাষায় ডাকঘর’এর প্রথম অনুবাদটি করেন লাওরা কানোপনিকা পিতলিন্সকায়ার। ১৯২২ সালে, সে নাটকের দ্বিতীয় অনুবাদ করেন ইয়ান সুর। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সুবাদে, পোল্যান্ড দেশে রবীন্দ্রনাথ তখন একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক। ডাকঘর’এর আগেই পোলিশ ভাষায় অনুদৃত হয়েছে ‘গীতাঞ্জলি’। ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ, Fruit Gathering, ‘রাজা’ নাটকের অনুবাদ,The King Of The Dark Chamber, সবই প্রকাশিত হয়েছে সে দেশের ভাষায়। সেই সুবাদে ‘ডাকঘর’ নাটকের অন্তর্মুখী ভাবনা, বিচক্ষণ কোরচাক সহজেই অনুভব করতে পেরছিলেন। বোধহয় সেইজন্যই তিনি ‘ডাকঘর’ মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

ডাকঘর একজন মৃত্যুপথযাত্রী বালকের গল্প। জীবনকে সে উপভোগ করতে চায় প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকে যে মানুষ, জীবজন্তু, পাখি, তাদের সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তার অভিভাবক, চিকিৎসক সকলেই তাকে গৃহবন্দী করে রাখে। হঠাৎ একদিন সে দেখে, ঠিক তার ঘরের সামনেই বসেছে রাজার নতুন ডাকঘর। তার বন্ধু প্রহরী তাকে বলে, একদিন তার নামেও রাজার চিঠি আসবে। রাজদূত খবর দেয়, স্বয়ং রাজা আসবেন তাকে দেখতে। খুশিতে ভরে ওঠে বালকের মন। বদ্ধ ঘরের দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে মুক্ত করে রাজা তাকে নিয়ে যাবেন খোলা আকাশের নিচে। সেই আকাশে অজস্র তারার মধ্যে কোনটা যে ধ্রুবতারা তিনি নিজে সেটা চিনিয়ে দেবেন।

১৯২১ সালে ডাকঘর প্রসঙ্গে সি, এফ, অ্যানড্রুজ’কে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

Amal representes the man whose soul has received the call of the open road — he seeks freedom from the comfortable enclosure of habits sanctioned by the prudent and from walls of rigid opinion built for him by respectable.

কোরচাক ডাকঘরের এই বাণীটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। যেতে হবে—হবেই। কিন্তু সেই বিদায়-লগ্নে মনে যেন কোন বিষাদের বেদনা না জাগে। এই অনুভব তাঁকে ‘ডাকঘর’ প্রযোজনার প্রেরণা জোগায়। ঘেটো’য় লেখা ডায়েরির একটা পাতায় তিনি লিখেছেন,

Man feels and ponders death as though it were the end, when in fact death is merely the continuation of life. It is another life. You may not believe in the existence of the soul, yet you must acknowledge that your body will live on as green grass, as a cloud. For you are, after all, water and dust.

এ কথা জানার পর, বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কেন তিনি ‘ডাকঘর’ নাটকটি মঞ্চায়নের কথা ভেবেছিলেন!

১৯৪২ সালের ১৮ই জুলাই। বিকেল সাড়ে চারটেয়, ওয়ারশ’এর কুখ্যাত ঘেটোয় মঞ্চস্থ হয় রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’। কোরচাক’এর তত্ত্বাবধানে সে নাটকের পরিচালনা করেন তাঁর এক অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রী, মিসেস এস্তেরিকা ভিনোগ্রন। অমল চরিত্রে অভিনয় করে আব্রসা নামে এক কিশোর। নাট্যানুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পত্রে কোরচাক লিখেছিলেন, “আমার বিশ্বাস এক ঘন্টার এই নাটক, যার লেখক একাধারে দার্শনিক ও কবি, সে নাটকের অভিনয় আপনাদের উচ্চ সংবেদনশীল মননকে সমৃদ্ধ করবে।” ডাকঘর মঞ্চায়ণের সময় ঘেটোয় উপস্থিত ছিলেন পোল্যান্ডের একজন মহিলা সমাজসেবী ইরিনা সেন্দেলরোভা। নাৎসী অত্যাচারের দিনে যিনি কয়েক’শ ইহুদী বালক-বালিকাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। তার ভাবনায়, “জানালার বাইরে কী ঘটনা ঘটছে তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এ নাটক মঞ্চস্থ করার কথা ভেবেছিলেন ডাক্তার কোরচাক। সেই কোমল হৃদয়ের মানুষটি জানতেন, কী ভয়াবহ দুর্যোগ শিশুদের জন্য অপেক্ষা করছে। তাই তিনি এমন একটি নাটক নির্বাচন করেছিলেন যার মূলমন্ত্র ছিল,আশাবাদ। চিঠি আসবে। রাজার চিঠি। সে চিঠিতে থাকবে এক নতুন জগতে পা ফেলার নিমন্ত্রণ। গ্যাস চেম্বারে প্রবেশ করার আগে ক্ষনকালের জন্য হলেও শিল্পী হিসাবে তাদের শেষবারের মতো আনন্দ দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য।” কোরচাক’এর জীবনিকার লিফটনএর বর্ণনায়, “ডাকঘর নাটকের অভিনয় শেষে গোটা হলঘরে নেমে আসে এক অদ্ভুত নীরবতা। যে রাজার আগমনের অপেক্ষায় আছে অমল সে কি মৃত্যু? না সে ঈশ্বর? না কি সে মৃত্যুরূপী ঈশ্বরের দূত? এই সমস্ত জিজ্ঞাসাবাদের উর্ধে, প্রতিটি দর্শকের নিঃশব্দ অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দেয়,এ নাটক তাদের দিয়েছে এক শান্তির বার্তা। ঘেটো’র অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের চেয়ে বাইরের আলোকিত মৃত্যু ভালো।” তখন এটাই ছিল কিছু মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সমাহিত উপলব্ধি।

তার পরের ঘটনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। ‘ডাকঘর’ মঞ্চায়নের ক’দিন পরেই কোরচাক ও তাঁর আশ্রমিক শিশুদের ত্রেবলিনকার মৃত্যুকূপে চালান করা হয়। সম্ভবত ১৯৪২ সালের ৭ই আগস্ট, সকাল ১০টায়।

যে প্রসঙ্গে এ কাহিনীর অবতারণা, আর তার বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছি বলে আমি মনে করিনা। তবুও সে গল্পের শেষে, মহাপ্রাণ কোরচাক ও তাঁর প্রিয় শিশুদের মহাপ্রয়াণের যে বিবরণ তাঁর জীবনীকার দিয়েছেন সেটা না বললে গল্পটা হয়তো শেষ হয়েও শেষ হয় না। লিফটন লিখেছেন, “সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। প্রায় দু’শো জন শিশুর মিছিলের পুরোভাগে চলেছেন কোরচাক। সবচেয়ে কম বয়সী শিশুটি রয়েছে তাঁর কোলে। অন্য একটি ছোট্ট শিশুর হাত ধরে, মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলেছেন তিনি। পিছনে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে চলেছে সারিবদ্ধ শিশুর দল। তাদের প্রত্যেকের পরনে নতুন পোশাক। কারো হাতে খেলনা, কারো হাতে বই। সেইসব নিয়ে হাসিমুখে তারা অনুসরন করছে তাদের প্রিয় শিক্ষককে। যেন একদল কুতূহলী শিশু, চেনা দেশের গন্ডি পেরিয়ে,বেরিয়ে পরেছে এক অচেনা দেশের সন্ধানে; এমনই ছিল তাদের এগিয়ে চলার ভঙ্গিমা।”

এ দৃশ্য যেন রবীন্দ্রনাথের নির্বিকল্প মৃত্যু ভাবনার চলচ্চিত্র। ‘ডাকঘর’ নাটকের কাহিনী, যেন সেই ভাবনার রূপক মাত্র।

এখন প্রশ্ন, রবীন্দ্রনাথ যদি সারা জীবনে ‘ডাকঘর’ ছাড়া অন্য কোনো নাটক না লিখতেন? তাহলে নাট্যকার হিসাবে তাঁকে আমারা কোন শ্রেণির পর্যায়ভুক্ত করতাম? প্রথম নাকি দ্বিতীয়?
তাপস মুখোপাধ্যায়
বাঁশবেড়িয়া, হুগলী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *